নিউজরাজ্য

বাংলার গর্ব দু’টাকার মাস্টার মশাই, ‘পদ্মশ্রী’ সন্মানে সন্মানিত হলেন বর্ধমানের সুজিত চট্টোপাধ্যায়

Advertisement
Advertisement

প্রত্যাশাহীন থেকেও কর্মে অবিচল হতে পারেন ক’জন মানুষ! তাও আবার এই গতিময়তার স্বার্থিক যুগে। নিজের গোটা অবসরজীবন মানুষ তৈরির কাজে ব্রতী হয়েছেন তিনি। শুনে অবাক লাগলেও, সত্যি এটা। তাঁর পারিশ্রমিক বছরে দু’টাকা। তাঁর নাম উঠে এলেই কপালে হাত ঠেকায় বর্ধমানবাসী, যেন তিনিই ঈশ্বর। আর আজ সেই স্বীকৃতিই জেলা পেরিয়ে ছড়াল গোটা দেশে। পদ্মশ্রী প্রাপক হিসেবে নাম ঘোষণা হল বর্ধমানের সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের নাম। এই খবরের পর আবেগে ভাসছে সুজিতবাবুর পরিবার। সূত্রে জানা গেছে, ৭৬ বছর বয়সী সুজিত বাবু সরকারি ভাবে অবসর নিয়েছেন পনেরো বছর আগে। তবে মনের বয়স অনেক কম। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত টিউশন পড়ানোই তাঁর নেশা। নিজের জন্য একটি নামও ঠিক করেছেন উনি, ‘সদাই ফকির’। ওঁর পাঠশালায় পড়ুয়ার সংখ্যা বর্তমানে তিনশোরও বেশি। টিউশন ফি বছরে মাত্র দু’ টাকা, এবং সেটাও পাঠগ্রহণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর দিতে হয়। সুজিতবাবুর কথায়, এটি গুরুদক্ষিণা। যা না নিলে শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

সদাই ফকিরের গুরুকুলের নিয়মানুযায়ী, দু’ টাকা গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিক্ষাগুরুকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে তবে পরীক্ষা দিতে যাবে পড়ুয়ারা। কিন্তু সে নিয়ম মানতে পারে না অনেকেই। তবু ছ’মাস পর মনে করে গুরুদক্ষিণা দিয়ে যায় তারা। তাঁর কথা অনুসারে, ”লিখে রেখো একফোঁটা দিলেম শিশির”, এটিই আপ্তবাক্য সদাই ফকিরের। অর্থাৎ, সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সারাবছর পড়ানোর পর জ্ঞানসমুদ্রের এক কণা শিশিরটুকুই তিনি দিতে পেরেছেন পড়ুয়াদের। এতই ওঁর সাধারণতা। তিনি শুধু পাঠদানই নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের স্বভাব, চরিত্রগঠনেরও শিক্ষা দেন। পদে পদে মনে করিয়ে দেন সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা। সহায়-সম্বলহীনদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পড়ুয়াদের উৎসাহিত করেন।

জানা গেছে, এই প্রবীণ দেবদূতক্ষমতা সম্পন্ন শিক্ষকের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম জঙ্গলের মাঝে বীরভূম জেলা লাগোয়া উত্তর রামনগর গ্রামে। মা আলোকলতার নামে পাঠশালার নাম রেখেছেন আলোকতীর্থ। শান্ত নিরিবিলি উঠানের শেষে সবুজে ঘেরা টিনের চালের দেড়তলা মাটির বাড়ি। বাড়ির সামনেই রয়েছে বাঁধানো কুয়ো, ধানের পালুই। সেই মাটির বাড়ির নীচের বারান্দায়, কখনও বা রোদ পিঠে নিয়ে পাঠশালা চলে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত। জঙ্গলের মাঝের এক একটি গ্রাম গেঁড়াই, বিষ্টুপুর, হেদোগেড়ে, জালিকাঁদর, শ্রীকৃষ্ণপুর, নৃপতিগ্রাম, কুড়ুম্বা, পুবার প্রভৃতি গ্রাম থেকে পনের-বিশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পড়তে আসে ছাত্র-ছাত্রীরা। ভোরে বেরিয়ে টিউশন পড়ে স্কুল সেরে একেবারে সন্ধ‍্যেয় বাড়ি ফেরে তারা। সুজিতবাবুর ছোটবেলার শিক্ষা গ্রামেরই রামনগর জুনিয়র হাইস্কুলে। এরপর বোলপুরের বাঁধগড়া হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে স্নাতক হন এবং এরপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন তিনি। এরপর ১৯৬৫ সালে ২২ বছর বয়সে জলপাইগুড়ি থেকে বিটি পাশ করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন তিনি। শিক্ষকতা শুরু করেন রামনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে। চল্লিশ বছরের বর্ণনাময় চাকরি জীবনের পর ২০০৪ সালে অবসর নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ঘনিষ্ঠ এই শিক্ষক।

বিশেষত, এলাকায় নিম্নবিত্ত পরিবারের সংখ্যা প্রচুর। শত দারিদ্রতার মধ্যেও তাদের জীবনসংগ্রাম বরাবরই নাড়া দিত সুজিত বাবুকে। তাই ৬৫ টাকার মাস মাইনেতে সাত ভাইকে মানুষ করার পরেও সহায় হতেন বাসিন্দাদের। শুধু তাই নয়, স্কুল ছুটির পর স্কুলেরই একটি ঘরে আলাদা করে দরিদ্র মেধাবীদের পড়াতেন বিনা খরচে। এমনকি, অবসর নেওয়ার পরও স্কুলকে বিনা বেতনে পড়াতে দেওয়ার আর্জিও জানিয়েছিলেন। যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ সে আবেদন গ্রহণ করেনি। এরপর মনের দিক থেকে প্রায় মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই সময়ই একদিন সকালে বহু দূরের গ্রাম থেকে কয়েকজন ছাত্রী এসে টিউশন পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ওনার কাছে। টিউশন ফির কথা উঠতেই মুখ মলিন হয়ে যায় তাদের। যদিও মনের কথা পড়তে বেশি সময় লাগেনি অভিজ্ঞ এই শিক্ষকের। শর্ত দেন, পড়াশোনা মন দিয়ে করতে হবে এবং বছর শেষে দিতে হবে এক টাকা গুরুদক্ষিণা। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছাত্রীদের মুখ। সেই থেকেই পথ চলা শুরু সদাই ফকিরের।

কিন্তু গুরুদক্ষিণা এত কম হ‌ওয়ার কারণ জানতে চাওয়ায় সুজিতবাবু জানান, “এমনিতেই এক একটি ছেলেমেয়েকে তিনটে চারটে করে টিউশন পড়তে হয়। সেজন্য মোটা টাকার খরচ বহন করতে হয় তাদের পরিবারকে। শুধু তাই নয়, পড়াশোনার জন্য আরও বাকি খরচ থাকে, আর আমি যদি আবার অন্যদের মতোই টিউশন ফি নিই তাহলে খুবই সমস্যা হবে তাদের। হয়তো অনেকে পড়াই ছেড়ে দেবে। আমার কাছে এই নিষ্পাপ সরল ছেলেমেয়েদের হাসিমুখের উজ্জ্বলতাই আসল, টাকা পয়সা নয়।” তাই অর্থ নয়, পিছিয়ে পড়া এলাকার এই পড়ুয়াদের ভালবাসাই একমাত্র পাথেয় সদাই ফকিরের।

Related Articles