করোনা শরীরে কোন কোন অঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে? কিভাবে আগে থেকেই বুঝবেন করোনার লক্ষণ? জেনে নিয়ে সতর্ক থাকুন

দেবপ্রিয়া সরকার : বর্তমান সময়ে আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস বা COVID-19। বিশ্বজুড়ে এট অরাজকতা সৃষ্টি করেছে এই ভাইরাস। প্রতিটি দেশে এ ভাইরাস রোধে বিভিন্ন সতর্কতামূলক প্রচার চলছে ও ভাইরাস সম্পর্কে প্রতিটি মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। ভারতে এখনো পর্যন্ত এ ভাইরাস ৮৩ জনের শরীরে সংক্রমণ ঘটিয়েছে, যাদের মধ্যে মারা গিয়েছে ২ জন। ন্যাশভিল-এর ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম শ্যাফনারের মতে, রোগাক্রান্ত মানুষের হাঁচি-কাশির ড্রপলেট বায়ুতে ঘুরে বেড়ায় এই ভাইরাস। এই ভাইরাসের অণুগুলো শরীরে প্রবেশ করে দ্রুত নাসাপথের পিছন দিকে বা গলার ভিতরের দিকে মিউকাস মেমব্রেনের ভিতরে গিয়ে সেখানকার কোষকে আক্রমণ করে। তখন সেই কোষই হয়ে ওঠে ওই ভাইরাসের গ্রাহক বা রিসেপ্টর কোষ। করোনা ভাইরাস মানুষের দেহের কোষের মূল আস্তরণ কে আঁকড়ে ধরে ভাইরাসের জিনগত উপাদানকে সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। সে উপাদান কোষের বিভাগ ক্ষমতার ওপর সম্পূর্ণ দখল করে ভাইরাসের বৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠায় সাহায্য করতে কোষকে বাধ্য করে।
জেনে নিন এই ভাইরাস শরীরের কোন কোন অংশে সংক্রমণ ঘটাতে ভূমিকা রাখে এবং এই ভাইরাসের সংক্রমণে কি কি শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
প্রথমতঃ এই ভাইরাস সর্বপ্রথম শ্বাস জনিত সমস্যা ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কোষ যখন বাধ্য হয়ে
ভাইরাসের বৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠার কাজে পুরো মন দেয় তখন ভাইরাস অণুগুলি ফেটে গিয়ে গ্রাহক কোষের চারপাশে থাকা অন্যান্য কোষগুলিকেও আক্রমণ করে। এর লক্ষন হিসেবে গলা ব্যাথা ও কাশি শুরু হয়। এরপর এই ভাইরাস বাড়তে বাড়তে ফুসফুসে এসে পৌঁছয় এবং ফুসফুসের মিউকাস মেমব্রেনে প্রদাহ তৈরি হয়। এর ফলে সারা দেহে অক্সিজেনে ও কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করার কাজটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়তঃ শিকাগো স্কুল অব মেডিসিনের প্যাথোলজি বিভাগের অধ্যাপক সু-ইউয়ান জিয়াও চিনের করোনা-আক্রান্ত রোগীদের রিপার্ট পরীক্ষা করে জানান যে এই ভাইরাস ফুসফুসের দুই পাশের পেরিফেরিয়াল অঞ্চলে আক্রমণ করে উপরের শ্বাসানালী ও ট্রাকিয়ার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস আক্রমনের আগে ফুসফুসের বিভিন্ন অংশগুলি ধোঁয়াশার মত থাকে। ভাইরাস আক্রমণের পর ওই ধোঁয়াশা যুক্ত অঞ্চলগুলি ধীরে ধীরে ঘন হতে থাকে।
তৃতীয়তঃ এই ভাইরাস নাক মুখ দিয়ে ঢুকে মিউকাস মেমব্রেনের পথ ধরে এগোতে থাকে। এই ভাইরাস পায়ুদ্বার পর্যন্ত ছড়ানো সম্ভাবনা থাকে। এই ভাইরাসের প্রভাবে জ্বর-সর্দি-কাশির সঙ্গে ডায়েরিয়া বা বদহজমের সমস্যা দেখা দেয়। এই ভাইরাসের সংক্রমণে অস্থিমজ্জা এবং লিভারের মতো অঙ্গগুলিও ফুলে উঠতে পারে। এই ভাইরাস শরীরে ছড়়িয়ে পড়া মাত্র শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এর সঙ্গে লড়াই শুরু করে, ফলে শরীরের প্রদাহযুক্ত অঞ্চলগুলির কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ভাইরাসের প্রভাবে শারীরিক যে ক্ষতি হয় তা শুধু ভাইরাসের জন্য নয়, কিছুটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্যও হয়।
চতুর্থতঃ এই ভাইরাস মস্তিষ্কে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে তা নিয়ে চিকিৎসকরা এখনো নিশ্চিত নন। সার্স নামক একটি ভাইরাস মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞানীরা সার্স ও Covid-19 এর মধ্যে অনেক মিল পেয়েছে। ফলে জার্নাল অব মেডিক্যাল ভায়ারোলজির গবেষকরা গত মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে যুক্তি দিয়েছিলেন যে করোনাভাইরাস কিছু কিছু স্নায়ুকোষ সংক্রামিত করতে পারে। তবে কতটা ক্ষতি করে সে বিষয়ে কিছু জানান নি। তাই এই বিষয়ে এখনই নিশ্চিত হয়ে কিছু ধরে না নেওয়াই ভাল।
পঞ্চমতঃ এই এই ভাইরাসে কেউ কেউ খুবই অসুস্থ বোধ করে আবার কেউ অতটা অসুস্থ হয় না এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা জানিয়েছে যে কোন ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর এই বিষয়টি নির্ভর করে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি সেই ব্যক্তি এই ভাইরাসের সংক্রমনের অতটা অসুস্থ বোধ করে না, কিন্তু যে ব্যক্তিগত প্রতিরোধ ক্ষমতা কম সেই ব্যক্তি এই ভাইরাসে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন। এছাড়া কোন ব্যক্তি যদি দীর্ঘমেয়াদি কোন সমস্যা যেমন ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, উচ্চ রক্তচাপ জনিত কোন সমস্যা থেকে থাকে বা বয়স্ক ব্যক্তির উপর এই ভাইরাসের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুমিত সেনগুপ্তের মতে, এই ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর প্রায় এক সপ্তাহ এটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে পারে। এরপরেই হঠাৎই জ্বর-সর্দি-কাশি বা নিউমোনিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। এই সময়ই লোকে সাধারণত সাধারণ সর্দি কাশির ঔষধ নিয়ে থাকে। সেই ওষুধের সুস্থও হয়ে ওঠে, কিন্তু তারপরে আবার কয়েক দিনের মধ্যেই একই সমস্যা শুরু হয়ে যায়। এছাড়া এই ভাইরাস পেটের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। এই ভাইরাস গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমকেও আক্রমণ করে বসে।
অতএব ; চিকিৎসকরা বারবার সতর্কবার্তা দিচ্ছেন যে, কোন রকম জ্বর সর্দি কাশির মতো সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অন্যথায় অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। যদি বার বার হাঁচি কাশি নেটে সমস্যা হয় তবে সাবান বা ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল রয়েছে এমন স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোওয়া খুব জরুরি। অ্যালকোহল শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্বাস্থ্যকর। তবে এই ধূমপান ও মদ্যপান হানিকারক হতে পারে। এছাড়া চিকিৎসকরা এই সময় বেশি করে জল ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।